‘মুক্ত গণতন্ত্র’ ও ‘রুদ্ধ রাজনীতি’—দুটি শব্দজোড়া হিসেবে আমরা দেখতে পারি।
প্রথমটি (মুক্ত গণতন্ত্র) হচ্ছে স্বপ্ন আর পরেরটি (রুদ্ধ রাজনীতি) হচ্ছে বাস্তবতা। পাঁচ বছর পরপর ঘুমিয়ে থাকা অনিশ্চয়তার সরীসৃপটি যেন আড়মোড়া ভেঙে নড়ে ওঠে। তখন দেশ, রাজনীতি, সমাজ—সবকিছু নড়ে ওঠে। দ্বিদলীয় রাজনৈতিক ব্যবস্থার দেশে ২০০১ সাল পর্যন্ত মোটামুটি একটা ধারা মেনে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি সরকার পরিচালনা করেছে।
এর পর থেকে ছলে-কৌশলে একদল নিকেশ করতে চায় অন্য দলকে। রাজনীতি সহজ হয়ে গেলে অন্য দল যেন সুবিধা না পায়, সে বিবেচনায় বদলে ফেলা হয় রণনীতি। আসলে রাজনীতির সমস্যার মূল বুঝতে ক্ষমতার কাঠামো দেখতে হবে এ (অ)ব্যবস্থা থেকে দূরে অবস্থান নিয়ে এবং এই চক্রব্যূহের বিরুদ্ধে ঠিক কোন দাওয়াই কাজ করবে, তা যেন এই সময়ের জিজ্ঞাসা।
সেই জিজ্ঞাসার জবাব খুঁজতে সহায়ক প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমানের ‘মুক্ত গণতন্ত্র রুদ্ধ রাজনীতি: বাংলাদেশ (১৯৯১-২০১৭)’ বইটি।
লেখক গত শতকের শেষ দশক থেকে কালের সরণি ধরে চলে এসেছেন চলতি শতাব্দীর প্রায় দুই দশক পর্যন্ত। এটি মূলত সেই সময়ের রাজনীতির এক অস্বস্তিকর চিত্রের ধারাবাহিক বয়ান।
আমাদের আত্মসমীক্ষার অনীহার কারণে রাজনীতির কাল নিয়ে এমন সমালোচনা ও বিশ্লেষণমূলক কোনো আলাপ হতে দেখি না। তবে এই বইয়ে তিনি কঠিন মনঃসংযোগ আর নিরাবেগ পেশাদারত্ব নিয়ে ত্রিকালদর্শীর মতো প্রায় তিন দশকের (১৯৯১-২০১৭) রাজনৈতিক যে আলেখ্য হাজির করেছেন, তা রাজনীতির গবেষকদের জন্য এক রেডি রেফারেন্স।
দেশের সব রাজনৈতিক দলেরই অভিমুখ সমাজ ও দেশের মানুষ এবং রাষ্ট্রের উন্নয়ন। বড় দুটি দলের রাজনীতির মৌল প্রকল্প অভিন্ন, কিন্তু নানা বাস্তবতায় তাদের অবস্থান আড়াআড়িভাবে একে অন্যের বিপরীতে। অথচ ইতিবাচক রাজনৈতিক মিথোজীবিতা রাজনৈতিক সংস্কৃতির সদর্থক পরিবর্তন সূচনা করে দল ও দেশের লক্ষ্য অর্জনে সহায়তা করতে পারত।
এ কথা স্বীকার করতে হবে, দেশে একধরনের সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা আছে, কিন্তু পাঁচ বছর পরপর এই বোধ দ্বারা আক্রান্ত হতে হয় যে দেশের রাজনীতি ও সমাজজীবনে ক্রান্তিকাল চলছে। এ এক পলিটিক্যাল প্যারাডক্স।
কেউ কেউ অনেক আগেই অনেক পরের জিনিস দেখতে পান। তাঁদের প্রজ্ঞা সেই অন্তর্দৃষ্টি তৈরি করে, যাতে তাঁরা ঘটিতব্য নিয়তি দেখতে পান। স্বৈরশাসকের পতনের পর বিএনপি ক্ষমতায় আরোহণের পর মতিউর রহমান যে কলাম লেখেন, তা আজ দুই দশক পরেও সমান সত্য।
বিএনপি সংসদ ও সরকার পরিচালনায় প্রয়োজনীয় যোগ্যতার পরিচয় দিচ্ছে না। জামায়াতে ইসলামী প্রশ্নে দ্বিধাগ্রস্ততা, আবার একাংশের জামায়াত-নির্ভরতা ভবিষ্যতেও থাকবে বলে মনে হয়...‘বিএনপি কোন পথে’ ( ২৩-২৮ পৃষ্ঠা) শিরোনামের রচনা দলটির উত্তরণের ব্যবস্থাপত্র হতে পারত, যদি দলটির নীতিনির্ধারকেরা পড়তেন।
দেশের রাজনৈতিক গুরুত্বপূর্ণ বাঁকগুলোর একজন নিবিড় প্রত্যক্ষদর্শী মতিউর রহমান। স্বাভাবিক আয়তনের চেয়ে বড় পরিসরে লেখা আলোচনাগুলো আলোকবিস্তারী। অযথা ভারী করা হয়নি। কৌশলী বাক্ছলের আশ্রয়ে সত্য চেপে যাননি। সাবেকি সম্পাদকদের মতো এমন মেরুদণ্ডী লেখাপত্রের স্বাদ পাওয়া যায় না এখন।
ছাত্রাবস্থায় বাম রাজনীতির অভিজ্ঞতাই হয়তো নব্বই-পরবর্তী ছাত্ররাজনীতির বিপ্রতীপ যাত্রা তাঁকে ব্যথিত করে, যার প্রকাশ আছে এই বইয়ে। ছাত্রলীগ আর ছাত্রদলকে সামলানোর কথা স্মরণ করিয়ে দেন প্রধানমন্ত্রীদ্বয়কে তাঁদের শাসন আমলে।
দৃষ্টির স্বচ্ছতা ও প্রকাশের প্রাঞ্জলতা বইটিকে কেঠো করেনি, বরং কেজো করেছে। উত্তরকালে বইটিকে তিন দশকের রাজনৈতিক কালতামামির স্মারক হিসেবে বিবেচনা করা হবে নিশ্চয়। কেবল সংবাদপত্রের সম্পাদকীয় দায়িত্ব পালন করতে তাঁর মতো অসংখ্য মামলার শিকার হতে হয়েছে খুব কম সম্পাদককে। তথ্য প্রকাশে প্রাতিষ্ঠানিক বিধিনিষেধ যে কতভাবে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে, তার উল্লেখ করে বেশ কিছু রচনা আছে।
তিনি ২০০৭ সালের তত্ত্বাবধায়কের আমলে ১৯২৩ সালের বিতর্কিত অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট বাতিলের কথা বলেন। বাতিল তো হয়ইনি, বরং তাঁর সহকর্মী সাংবাদিক রোজিনা ইসলামকে হতে হয় সেই মামলার শিকার। আইনের সমূহ খড়্গ মুক্ত সাংবাদিকতার হুমকি হয়ে চোখ রাঙায় সর্বদা। ‘আবার সব বলতেও পারি না, ভয় কাজ করে’ (বইয়ের ভূমিকা, ১৫ পৃষ্ঠা)-এর মতো হৃৎ–চেরা হাহাকার আর কী হতে পারে?
এমন সন্দর্ভ আমাদের সাংবাদিকতার ইতিহাসে বিরল নয়। আবুল মনসুর আহমদ, ফয়েজ আহমদ প্রমুখের ধারা মেনে ইতিহাস-বিচারের এক স্বীকৃত চর্চা। রাজনৈতিক ইতিহাসচর্চার এই দৃষ্টিভঙ্গিতে সত্য আছে বলে মনে করি। একাত্তরের অর্জন প্রমাণ করেছে, জাতীয় সাধনা ও জাতীয় সংগ্রামের মধ্য দিয়ে জাতির নিয়তির পরিবর্তন সম্ভব।
এই সদর্থক পরিবর্তন ঘটানোর কাজে জাতির জীবনে ইচ্ছা, জাতীয় ইতিহাসের জ্ঞান এবং অতীত অভিজ্ঞতা থেকে যথাযথ শিক্ষা গ্রহণ অপরিহার্য। ইতিহাসের নামে স্বকল্পিত ও ফরমায়েশি প্রচার ইতিহাসনিষ্ঠ থাকতে দেয় না। শস্যদানা থেকে তুষ বাছাইয়ের মতো তা আস্তাকুঁড়ে স্থান পায়। মনে রাখা উচিত সেই আপ্তবাক্য—পেছনে তুমি যত দূর দেখতে চাও, ততটাই সামনে তুমি দেখতে পাবে।
রাষ্ট্রীয় জীবনে ন্যূনতম ‘রাজনৈতিক গণতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠার জন্য এ দেশের জনগণ সংগ্রাম করে আসছে। গণতন্ত্রবঞ্চিত প্রতিবাদীদের ত্যাগে সেসব সংগ্রামে কিছু ক্ষেত্রে বিজয়ও অর্জিত হয়েছে, কিন্তু অপরিণামদর্শী রাজনীতিক ও ধনিকশ্রেণির কারসাজিতে সে বিজয় বারবারই হাতছাড়া হয়েছে। নব্বইয়ে সামরিক স্বৈরশাসন উৎখাতের মধ্য দিয়ে নির্বাচিত সরকারের কাঠামো পুনঃপ্রতিষ্ঠা পেয়েছিল। কিন্তু তারপরও ‘রাজনৈতিক গণতন্ত্র’ অর্জিত হয়নি।
‘এখন দুই নেত্রীর কাছে প্রত্যাশা’ (৩৪২-৩৪৬ পৃষ্ঠা) শিরোনামের রচনায় যে আশা করা হয়, তা আসলে মরীচিকাই রয়ে গেছে। বিএনপি ও আওয়ামী লীগ আজকে যে পরস্পরবিরোধী অবস্থানে পৌঁছেছে, তাতে দেশ আরও বেশি ‘গণতন্ত্রহীন’ অন্ধকারে নিক্ষিপ্ত হয়েছে।
রাজনীতিপ্রীতির ঊর্ধ্বে কোনো প্রপঞ্চ যেন। রাজনীতির খেলায় হারজিত থাকবেই। যেকোনো এক দলকে পরাজয় নিয়ে মাঠ ছাড়তে হবে। কিন্তু অভ্রান্তভাবে যেন সবাইকে জয়ী হতে হবে; বর্তমান সময়ের রাজনীতি দেখে অন্তত তা-ই মনে হয়। যেহেতু রাজনীতি জিরো সাম গেম, তাই এক দলকে ব্যর্থ হতেই হয়। ব্যর্থতাকে যুক্তিগ্রাহ্য করার জন্য রাজনীতিকেরা একটি ‘অপয়া’কে খুঁজে তাকে শিকার করেন। এখন রাজনীতিই যেন সেই ‘অপয়া’।
প্রধান দল দুটি আদর্শ প্রশ্নে মেরুপ্রতিম দূরত্বে অবস্থান করলেও ক্ষমতা প্রশ্নে যেন যমজ সমদর্শিতা ধারণ করে। একে অপরে মিশে যায় সুষম কোনো দ্রবণের মতো। নৃবিজ্ঞানী ক্লদ লেভি স্ট্রসের জায়মান যমজতার (ইনসিপিয়েন্ট টুইনহুড) ফলিত রূপায়ণে প্রধান দুই দল যেন নায়ক আর প্রতিনায়কের ভূমিকায়, তারই বর্ণনা দেশের প্রধান পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে লিখে আসছেন মতিউর রহমান।
এলিয়ট একবার বলেছিলেন, জেনুইন পোয়েট্রি ক্যান কমিউনিকেট বিফোর ইট ইজ আন্ডারস্টুড (বুঝে ওঠার আগেই উৎকৃষ্ট কবিতা মনে রেখাপাত করে)। পড়তে পড়তে কবিতা বোধের সীমানায় প্রবেশ করে, কিন্তু আমরা রাজনীতির ভেতরে বসবাস করলেও অবোধ্য থেকে যায়। তবে এ অবোধ্যতাকে চ্যালেঞ্জ করে মতিউর রহমানের ‘মুক্ত গণতন্ত্র রুদ্ধ রাজনীতি: বাংলাদেশ (১৯৯১-২০১৭)’ বইটি, যা এই বই এবং রচয়িতা হিসেবে এর লেখকের স্থানাঙ্ক নির্ধারণে সাহায্য করবে কালের বিচারে ।